চলতি শতকের, এবং একই সাথে সাম্প্রতিক অতীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানীর নাম অধ্যাপক স্টিফেন হকিং। ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ৭৬ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে নিজের বাসভবনে মৃত্যু ঘটে তার। তবে মৃত্যুর আগে নিজের বিষয় তথা থিওরেটিকাল কসমোলজি ছাড়াও বিজ্ঞানের আরো নানা দিক সম্পর্কে প্রায়ই খোলামেলা আলোচনা করতেন তিনি। তেমনই একটি বিষয় হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
তবে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো, আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যান্য অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কেই বেশ ইতিবাচক ধারণা পোষণ করলেও, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে যেন কিছুটা বিরূপ ধারণাই ছিল তার মনে। প্রায়ই এটিকে তিনি মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ বলে অভিহিত করতেন। কথা বলতেন এর সম্ভাবনা ও আশঙ্কা নিয়ে; এবং একই সাথে এটি সম্পর্কে আমাদের কী ভাবা উচিৎ, স্রেফ বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ হিসেবেই নয়, সাধারণ মানুষ হিসেবেও।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রসঙ্গে নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন হকিং; Image Source: Medium
চলুন পাঠক, জেনে নিই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে স্টিফেন হকিংয়ের বলা সবচেয়ে আলোচিত পাঁচটি উক্তি সম্পর্কে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানবসভ্যতার সমাপ্তি ঘটাবে কি না
পূর্ণাঙ্গ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উদ্ভবের মাধ্যমে মানবসভ্যতার ইতি ঘটবে। নিজের নিয়ন্ত্রণ এটি নিজের হাতেই তুলে নেবে, এবং নিজেকে নতুন আঙ্গিকে তৈরি করবে এক ক্রমবর্ধমান গতিতে। মানবজাতি, যারা সীমাবদ্ধ খুবই ধীরগতির জৈবিক বিবর্তনে, কিছুতেই পেরে উঠবে না এটির সাথে, এবং এটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাবে মানুষকে।
- ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে
ডাটা এবং প্রসেসিং পাওয়ারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে শেয়ার্ড থিওরেটিকাল ফ্রেমওয়ার্ক। এটি অভূতপূর্ব সাফল্য বয়ে এনেছে প্রযুক্তির বিভিন্ন অঙ্গনে, যেমন স্পিচ রিকগনিশন, ইমেজ ক্লাসিফিকেশন, অটোনোমাস ভেহিকলস, মেশিন ট্রান্সলেশন, লেগড লোকোমোশন, কোশ্চেন-আন্সারিং সিস্টেম প্রভৃতিতে।
যেহেতু এসব অঙ্গন ও অন্যান্য খাতের সক্ষমতা পরীক্ষাগারের গবেষণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই গোটা বিষয়টি একটি চক্রাকারে চলতে থাকে, এবং কোনো একটি অংশের সামান্যতম উন্নতিও গোটা চক্রটিকে প্রভাবিত করে, যার সাথে যুক্ত থাকে মোটা অংকের অর্থ ও বিনিয়োগ। এ কথা এখন সর্বসম্মতভাবে সত্য যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের গবেষণা ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং তাই সমাজের উপর এর প্রভাবের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা, তাই কীভাবে এ থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুবিধাটুকু নিংড়ে বের করা যেতে পারে এবং ক্ষতিগুলোও যথাসম্ভব এড়ানো যেতে পারে, সে সম্পর্কে গবেষণা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- রিসার্চ প্রায়োরিটিজ ফর রোবাস্ট অ্যান্ড বেনিফিসিয়াল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে। এটি মূলত একটি খোলা চিঠি, যেখানে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে স্বাক্ষর করেছিলেন হকিং।

হকিং ভাবতেন মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স; Image Source: bdtechtalks.com
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রসঙ্গে
আমি বিশ্বাস করি একটি জৈবিক মস্তিষ্কের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব এবং একটি কম্পিউটারের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব, তার মধ্যে কোনো গভীর পার্থক্যই আসলে নেই। আর তাই এ কথা বলা যেতেই পারে যে, তাত্ত্বিকভাবে, কম্পিউটার চাইলে মানব বুদ্ধিমত্তাকে অনুসরণ করতে পারে, তার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে, এমনকি সেটিকে ছাড়িয়েও যেতে পারে।
- ২০১৬ সালের অক্টোবরে, যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে লেভারহাল্ম সেন্টার অব দ্য ফিউচার অব ইন্টেলিজেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাখা হকিংয়ের বক্তৃতা থেকে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে মানুষের উপকার প্রসঙ্গে

ওয়েব সামিটে বক্তৃতা রাখছেন হকিং; Image Source: Getty Images
সম্ভবত আমাদের সকলেরই উচিৎ এক মুহূর্তের জন্য থামা। কীভাবে আর্টিফিশিয়ালকে আরো ভালো ও সফল করে তোলা যায়, সেটির উপরই কেবল মনোযোগ না দিয়ে, আমাদের চিন্তা করা উচিৎ কীভাবে এর মাধ্যমে মানবসভ্যতারও সহায়তা করা সম্ভব।
- ২০১৭ সালের নভেম্বরে, লিসবনের ওয়েব সামিটে রাখা হকিংয়ের এক বক্তৃতা থেকে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কর্তৃক মানুষের প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে
দৈত্য এখন প্রদীপ থেকে বের হয়ে এসেছে। আমাদের এখন সামনের দিকে এগিয়ে চলা উচিৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে। কিন্তু সেই সাথে এর সত্যিকারের ঝুঁকি ও হুমকিগুলোর ব্যাপারেও আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমি ভীত যে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়তো কোনো এক সময় মানুষকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপিত করে ফেলবে। মানুষ যদি কম্পিউটারের জন্য ভাইরাসের নকশা তৈরি করতে পারে, তাহলে কেউ একজন নিশ্চয়ই এমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সেরও নকশা তৈরি করবে, যেটি নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। এভাবে প্রাণের একদম নতুন একটি রূপ সৃষ্টি হবে, যা সাধারণ মানুষকে হার মানিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
- ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়্যারডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে।
শুনিয়েছেন আশার বাণীও
বলাই বাহুল্য, জীবদ্দশায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভয়াবহতা নিয়ে চরম মাত্রায় শঙ্কিত ছিলেন হকিং। কিন্তু তাই বলে তিনি যে পুরোপুরি হতাশাবাদী ও নেতিবাচক মানসিকতার একজন ব্যক্তি ছিলেন, তা-ও কিন্তু নয়। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে চাইলেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ বাস্তবতাকে এড়ানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নির্মাতাদের প্রয়োজন সৎ প্রচেষ্টা এবং কার্যকরী ব্যবস্থাপনা।

শুনিয়েছেন আশার বাণীও; Image Source: HuffPost
“আমি খুবই আশাবাদী, এবং আমি মনে করি আমাদের পক্ষে এমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গড়ে তোলা সম্ভব, যা সমগ্র পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর হবে। আমি মনে করি এটি আমাদের সাথে এক ঐকতানে কাজ করতে পারবে। এজন্য আমাদের স্রেফ সম্ভাব্য বিপদগুলোর ব্যাপারে সতর্ক হওয়া, সেগুলোকে শনাক্ত করা, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলোর সর্বোৎকৃষ্ট প্রয়োগ, এবং আগেভাবে ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে প্রস্তুত হয়ে নেয়া প্রয়োজন।”
হকিং একা নন
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপারে নিজের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন, এমন ব্যক্তি কিন্তু হকিং একা নন। টেসলা ও স্পেস এক্সের সিইও এলন মাস্কও বলেছিলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নাকি তৃতীয় বিশযুদ্ধ ঘটাতে পারে। এমনকি তিনি এ প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যেন মানবজাতি যন্ত্রের সাথে একীভূত হয়ে যায়, যাতে করে তারা ভবিষ্যৎ পৃথিবীতেও নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পারে।

হকিংয়ের সাথে এক কাতারে রয়েছেন বিল গেটস ও এলন মাস্কও; Image Source: CNBC
এছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে সামাল দেয়ার জন্য এক অভিনব পন্থার কথা বলেছিলেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তিনি বলেছিলেন, রোবটদের জন্যও আয় কর প্রদান বাধ্যতামূলক করা উচিৎ, যাতে করে তারা কখনো সীমাছাড়া হয়ে না যায়!
রয়েছে ব্যতিক্রমও
হকিং, মাস্ক বা গেটস আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীতি প্রকাশ করলে কী হয়েছে, ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ কিন্তু একেবারেই ব্যতিক্রম। তিনি বলেছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তিনি “সত্যিই অনেক বেশি আশাবাদী”।