সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীই মনে করে এক পরম আশীর্বাদ হিসেবে। কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে গিয়ে হাজির হতে পারে, এবং নিজেদের পণ্যের সর্বোচ্চ বিক্রি নিশ্চিত করতে পারে।
কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের কথাও একটিবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই কিন্তু আবার যে কারো ব্যবসার চূড়ান্ত সর্বনাশ করে ছাড়তে পারে। সম্প্রতি বিবিসিতে প্রকাশিত “কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনার ব্যবসাকে ধ্বংস করে” শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ের উপরই আলোকপাত করা হয়েছে।
পিট নট নামক একজন অনলাইন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ সেখানে বলেছেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে পারে আপনার কোম্পানির সম্মানের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ। যদি এটিকে গুরুত্বের সাথে নেয়া না হয়, তাহলে এটিই পারে আপনার কোম্পানিকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রভাবিত করতে।”

পিট নট; Image Source: Getty Images
সর্বপ্রথম কারণ হিসেবে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ভুয়া সংবাদের কথা। আজকাল অনলাইনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া সংবাদ তৈরি করে ছড়িয়ে দেয়া হয়, যার কারণে অনেক কোম্পানির নামেই মিথ্যে গুজব ছড়ায়।
উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে যুক্তরাজ্যের মেট্রো ব্যাংকের কথা। এ বছর মে মাসেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, ব্যাংকটি নাকি অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দরুণ লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এ মিথ্যা তথ্য, এবং দেরি না করে এ ব্যাংক থেকে নিজেদের শেয়ার উঠিয়ে নিতে শুরু করে অনেক মানুষ। তাৎক্ষণিকভাবে এ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও, শেয়ার বাজারে ব্যাংকটির ১১ শতাংশ দরপতন ঘটে।
জেনেভা ভিত্তিক ইন্টারনেট নিরাপত্তা কোম্পানি ইমিউনি ওয়েবে কর্মরত ইলিয়া কোলোচেঙ্কোর মতে, কখনো কখনো ভুয়া সংবাদের পরিণতি আরো ভয়াবহ হতে পারে, যদি সেখানে মানব হ্যাকারদেরও সংশ্লিষ্টতা থাকে।
“হ্যাকাররাও আপনার কোম্পানির খুব বড় ক্ষতি করে দিতে পারে, যদি কোনোভাবে তাদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা সংবাদ পোস্ট করা সম্ভব হয়,” বলেন কোলোচেঙ্কো।

ইলিয়া কোলোচেঙ্কো; Image Source: Getty Images
“মনে করুন কেউ একজন বিবিসির সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়ল, এবং সেখানে একটি সংবাদ প্রকাশ করল যে ইরান পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে। এর প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব কিন্তু হবে সাংঘাতিক, বিশেষ করে অন্যান্য সংবাদ নেটওয়ার্কগুলো বিবিসির বরাত দিয়েই সংবাদটি প্রকাশ করতে শুরু করে দিলে।”
তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট যে সব সময় মিথ্যাই হতে হবে, এমন কোনো কথাও কিন্তু নেই। অনেক সময় সত্যি কথাও হানতে পারে বড় ধরনের আঘাত।
২০১৬ সালে ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাং এসডিআইয়ের বাজার দর অর্ধ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও কমে যায়, যখন টেসলা বস এলন মাস্ক টুইট করেন যে কোম্পানিটি তাদের পরবর্তী ইলেকট্রিক কারের জন্য প্যানাসনিকের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।
যদি ভালো মতো চিন্তা না করেই কাজ করা হয়, তাহলে নিজেদের করা পোস্টও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন এ বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের চেজ ব্যাংক প্রচণ্ড সমালোচনার শিকার হয় “পুয়োর শেমিং”-এর অভিযোগে। তারা একটি পোস্ট প্রকাশ করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল লো ব্যাংক ব্যালান্সের অধিকারী ভোক্তারা যেন ক্যাব ভাড়া ও কফি ক্রয় এড়িয়ে সেই অর্থ সঞ্চয় করে।
এসবের বাইরেও অন্যান্য হুমকির মধ্যে রয়েছে প্রতারক চক্রের চক্রান্ত। আপনার ব্র্যান্ড ভ্যালু কমানোর জন্য তারা বিভিন্ন হীন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
“অনেক চক্রান্তকারীই বেশ সৃজনশীল মানসিকতার হয়ে থাকে। তারা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্যামের মাধ্যমে বড় কোম্পানিগুলোর নাম ডোবানোর চেষ্টা করে থাকে,” বলেন কোলোচেঙ্কো।
ক্রেতা সাধারণের প্রতিক্রিয়াও আজকাল বড় কোম্পানিগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ জেনে গেছে, তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সেরা জায়গাটি হলো ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি। এর মাধ্যমে তারা নিজের প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি অন্য অনেক মানুষের মনোযোগও আকৃষ্ট করতে পারবে।
তাই তো কোনো একজন মানুষ যদি কোনো ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনে, এবং সেটি যদি একবার ভাইরাল হয়ে কোনো ট্রেন্ডে পরিণত হয়, তাহলে অনুরূপ আরো অসংখ্য মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যারাও ওই একই পণ্য বা ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে তাদের নেতিবাচক মতামত ব্যক্ত করতে শুরু করে।
এ ধরনের হুমকি থেকে বাঁচার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো দ্রুততম পদক্ষেপ গ্রহণ। বেলোরুশিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং কোম্পানি আওয়ারিওর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাশা মাকসিমাভা বলেন, “অনলাইনে নিজেদের রেপুটেশন ম্যানেজমেন্টের প্রধান উপায় হলো নেতিবাচক মতামতগুলোকে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে সামলানো, যাতে সেগুলো মহামারী হয়ে না ওঠে।।”
এদিকে লোপা ঘোষ নামের এক বৈশ্বিক প্রফেশনাল সার্ভিস বিশেষজ্ঞ বলেন, “সঠিক পরিকল্পনা সবচেয়ে জরুরি।”

লোপা ঘোষ; Image Source: Getty Images
একবার যদি অনলাইনে কোনো কোম্পানির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, তাহলে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অনলাইনেই ওই কোম্পানির ভাবমূর্তি আবারো উজ্জ্বল করার চেষ্টা করতে হবে।
এ ব্যাপারে নট বলেন, “হারানো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলো একটি দারুণ জায়গা। তাই ভেবে বের করুন, কীভাবে আপনি আপনার প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে আপনার কোম্পানির মূল্যমানকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারেন, এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ের দুর্বল জায়গাটিকে ছুঁয়ে গিয়ে তাদের সহানুভূতিও আদায় করে নিতে পারেন।।”
হ্যাকাররা যেহেতু সব সময় ওঁত পেতে থাকে কোনো বড় কোম্পানির সিস্টেমে প্রবেশ করে তাদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়তে, তাই সিস্টেমের নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি ওই কোম্পানিতে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সচেতনতাও অনেক জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কোম্পানি সংশ্লিষ্ট কারো অ্যাকাউন্টে বা মেইলেই এমন কোনো স্পর্শকাতর ডাটা রাখা যাবে না, যেগুলোর মাধ্যমে ওই কোম্পানিকে টেনে নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়।

হ্যাকাররা ওঁত পেতে রয়েছে সব সময়; Image Source: Getty Images
কোনো কোম্পানিকে এ ধরনের দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করায় বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও। সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোতে ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন মনিটরিং ও লিসেনিং টুল। আর এসব টুল কাজে লাগায় অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুরূপ দুর্যোগ মোকাবেলা ও হারানো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা খুবই সম্ভব।
তবে এসব টুল ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং-ও হতে পারে, “বিশেষত আপনার ব্র্যান্ডের নামটি যদি খুবই পরিচিত ও নিত্য ব্যবহার্য কিছু একটা হয়; যেমন ধরুন, অ্যাপল,” বলেন মাকসিমাভা।

মাশা মাকসিমাভা; Image Source: Getty Images
“তাই প্রধান যে তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারপ করা প্রয়োজন তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে অনুভূতি বিশ্লেষণ, যাতে করে আপনি শুরুতেই নেতিবাচক উল্লেখগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এছাড়াও রয়েছে সঠিক সময়ের ফলাফল, যাতে করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। আর সব শেষে রয়েছে নমনীয়তা, যাতে করে আপনার কি-ওয়ার্ড অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থক হওয়া সত্ত্বেও আপনি অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখগুলোকে বাদ দিতে পারেন।”
কিন্তু সব শেষে নট সাবধান করে দেন যে, এগুলো করতে গিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়ে যেন হস্তক্ষেপ করা না হয়। “সোশ্যাল লিসেনিং টুল ব্যবহার করার অনেক উপকারিতা রয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োগ অবশ্যই হতে হবে সঠিক উপায়ে।”