বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আমাদেরকে শিখিয়েছে ডিজিটাল মস্তিষ্কের জাগরণ বা ক্রমোন্নয়নকে ভয় পেতে, সন্দেহের চোখে দেখতে। কেননা যন্ত্রের হাতে ও মাথায় অত্যাধিক ক্ষমতা চলে গেলে তা নাকি মানবসভ্যতার চরম বিপর্যয়ের কারণ হবে। আসলেই কি তাই? যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ? সাম্প্রতিক ক গবেষণার ফলাফল কিন্তু ভিন্ন কথাই বলছে।
ন্যাচার মেডিসিনে প্রকাশিত নতুন গবেষণা প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে গুগল ও একদম মেডিকেল পেশাদারদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা একটি অ্যালগরিদম কর্তৃক ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ে অভাবনীয় সাফল্যের কথা। সেখানে আরো দেখানো হয়েছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রেডিওলজিস্টদের চেয়েও অপেক্ষাকৃত নির্ভুলভাবে মেডিকেল স্ক্যানে ক্যান্সারের চিহ্ন শনাক্ত করতে সক্ষম।

ক্যান্সার নির্ণয়ে এক নতুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স উদ্ভাবন করেছে গুগল; Image Source: Getty Images
ইতিপূর্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরীক্ষিত বেশ কিছু ডিপ লার্নিং অ্যালগরিদমের মতো, এই গবেষণায় অংশ নেয়া কম্পিউটার মস্তিষ্কটিকেও অতীতের বিভিন্ন ফুসফুসের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং থেকে নেয়া স্ক্যান দ্বারা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এরপর সেটিকে ৬,৭১৬টি ক্যান্সার স্ক্রিনিং স্ক্যান (যেগুলো ইতিমধ্যেই রেডিওলজিস্টদের দ্বারা পরীক্ষিত) দিয়ে দেখতে চাওয়া হয়েছিল, তা কতটা যথাযথভাবে ক্যান্সার নির্ণয় করতে সক্ষম। ফলাফলে যা দেখা গেছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। ৯৪.৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটি সঠিকভাবে ক্যান্সার নির্ণয় করতে পেরেছে।
এরপর অ্যালগরিদমটিকে ছয়জন রেডিওলজিস্টের মানব মস্তিষ্কের সম্মুখীন করানো হয় এটি যাচাইয়ের জন্য যে, একদম নতুন বিভিন্ন স্লাইডের মধ্য থেকে ক্যান্সার শনাক্ত করার ব্যাপারে কম্পিউটার ও মানুষ ঠিক কতটা দক্ষ।
স্ক্রিনিং ডাটা সেটগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে রেডিওলজিস্টদের জন্য টমোগ্রাফি স্ক্যানের মাধ্যমে কিছু অতিরিক্ত ও সম্পূরক তথ্য সংযোজিত হয়। দেখা যায়, টমোগ্রাফি থাকার সুবাদে পেশাদার রেডিওলজিস্ট এবং মানুষ উভয়ই প্রায় সমান যথার্থতার সাথে ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারছে। কিন্তু মূল পার্থক্যটা লক্ষণীয় সেসব ক্ষেত্রে, যেখানে বাড়তি কোনো টমোগ্রাফি ছিল না। এসব ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তাদের মানব মস্তিষ্কের অধিকারী প্রতিপক্ষদের হারিয়ে দিতে সমর্থ হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কম্পিউটার তার ছয় মানব প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১১ শতাংশ কম ভুল পজিটিভ এবং ৫ শতাংশ ভুল নেগেটিভ ফলাফল দেয়।

মানব চিকিৎসকদের বিশেষ সাহায্য করবে নতুন এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স; Image Source: Getty Images
অনেকের কাছেই এটিকে মানব চিকিৎসকদের জন্য দুঃসংবাদ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্ট্রা স্মার্ট কম্পিউটারের লক্ষ্য কখনোই পেশাদার চিকিৎসকদের জায়গা দখল করা নয়। ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে চিকিৎসকেরা সবসময়ই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবেন। কিন্তু যদি মানব চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা ও অগাধ জ্ঞানের সাথে ডিপ লার্নিং অ্যালগরিদমের মস্তিষ্ক যুক্ত হয়, তবে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে ক্যান্সার নির্ণয়ে ভুলের হার অনেকটাই হ্রাস পাবে, ফলে পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, গড় আয়ুষ্কালও বৃদ্ধি পাবে।
ঠিক কতটা তাৎপর্যপূর্ণ গুগলের এই নতুন উদ্ভাবন? তা অনুধাবনের জন্য আমাদেরকে ফিরে তাকাতে হবে সাম্প্রতিক অতীতে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর গড়ে ১.৭ মিলিয়ন মানুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জীবন হারাচ্ছে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের রোগটি ধরা পড়ছে একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে, যখন আর তাদেরকে সম্ভাব্য সেরা চিকিৎসা প্রদান করেও সারিয়ে তোলার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে না।

প্রতিবছর ফুসফুস ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে ১.৭ মিলিয়ন মানুষ; Image Source: Medical News Today
কিন্তু গুগলের এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটি যদি বিশ্বব্যাপী সকল ক্যান্সার হাসপাতালে ছড়িয়ে দেয়া যায়, এবং চিকিৎসকরা রোগীর সম্ভাব্য ক্যান্সার নির্ণয়ে এটির ব্যবহার শুরু করেন, তাহলে অনেক আগে থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তার চিকিৎসা শুরু করে দেয়া সম্ভব হবে। ফলে প্রতিবছর এই বিশেষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ড. এরিক টোপোল, স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক, এ প্রসঙ্গে বলেন: “নতুন এই উদ্ভাবনে চিকিৎসকদের কোনো ক্ষতি হবে না। ধারণাটি মূলত তাদেরকে সাহায্য করার, তাদের জায়গা দখল করার নয়। এটি তাদের জীবনকে আরো সহজ করে দেবে। ক্যান্সার নির্ণয়ে সব মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভুল নেগেটিভ ফলাফল আসে, যে কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু নতুন উদ্ভাবিত এই অ্যালগরিদম সংখ্যাটিকে কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।”

ড. এরিক টোপোল; Image Source: Time Magazine
তবে নতুন এই উদ্ভাবনের আরেকটি সম্ভাব্য সমস্যার দিকে আঙ্গুল তুলেছেন ড. টোপোল, যেটিকে গুরুত্ব দিতেই হবে। কোনো একজন রেডিওলজিস্ট যদি একটি স্ক্যান পাঠ করে ক্যান্সার শনাক্ত করতে ভুল করেন, তাহলেও ক্ষতি হচ্ছে কেবল একজন রোগীরই। কিন্তু কোনো কারণে যদি সমগ্র আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমটিতেই কোনো সমস্যা হয়, যেমন ধরুন সেটি হ্যাক হয় বা সেটিতে কোনো বাগ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে তো বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার রোগীর ক্ষতি হয়ে যাবে। অর্থাৎ মানুষের তুলনায় যন্ত্রের কার্যকারিতা বেশি হতে পারে বটে, কিন্তু সেই যন্ত্রের পক্ষেই আবার একসাথে অনেক বেশি মানুষের ক্ষতি করে দেয়াও সম্ভব।
অবশ্য এই সমস্যার সমাধানে ড. টোপোলের কাছে একটি পরামর্শ রয়েছে, যদিও তা অনেকের কাছেই বাড়তি ঝামেলা বলে মনে হতে পারে। তিনি বলেছেন, এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটি যদি ভবিষ্যতে অন্য সকল পরীক্ষায় পাশ করে বিশ্বব্যাপী অনুমোদন পেয়ে যায়ও, তবু ব্যবহারের সময়ে প্রতিনিয়ত এটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, এবং খুঁজে দেখতে হবে সিস্টেমটি হ্যাক হলো কি না অথবা সফটওয়্যারে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুত রয়েছে কি না।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই ক্যান্সার নির্ণয়ের ভবিষ্যৎ; Image Source: University of Waterloo
খুব শীঘ্রই হয়তো গুগল তাদের এই নতুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটিকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেবে না। কারণ তার আগে তাদেরকে আরো ভালোভাবে সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই, গুগল চাইবে প্রথমে এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটিকে যুক্তরাষ্ট্রে উন্মুক্ত করতে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে আগে দেশটির ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর অনুমোদনও পেতে হবে।
উল্লেখ্য, শুধু ফুসফুস ক্যান্সারই নয়, অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন স্তন ক্যান্সার, ত্বকের ক্যান্সার এবং ওভারিয়ান (ডিম্বাশয়) ক্যান্সার নির্ণয়ে ইতিমধ্যেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সুতরাং এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাঝেই নিহিত রয়েছে ক্যান্সার নির্ণয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।